বিধাতা যেদিন মোর মন করিলা সৃজন বহু-কক্ষে-ভাগ-করা হর্ম্যের মতন, শুধু তার বাহিরের ঘরে প্রস্তুত রহিল সজ্জা নানামতো অতিথির তরে; নীরব নির্জন অন্তঃপুরে তালা তার বন্ধ করি চাবিখানি ফেলি দিলা দূরে। মাঝে মাঝে পান্থ এসে দাঁড়ায়েছে দ্বারে, বলিয়াছে "খুলে দাও'-- উপায় জানি না খুলিবারে। বাহিরে আকাশ তাই ধুলায় আকুল করে হাওয়া; সেখানেই যত খেলা, যত মেলা, যত আসাযাওয়া। অন্তরের জনহীন পথে হিমে-ভেজা ঘাসে ঘাসে শেফালিকা লুটায় শরতে। আষাঢ়ের আর্দ্রবায়ুভরে কদম্বকেশরে চিহ্ন তার পড়ে ঢাকা। চৈত্র সে বিচিত্র বর্ণে কুসুমের আলিম্পনে আঁকা। সেথায় লাজুক পাখি ছায়াঘন শাখে, মধ্যাহ্নে করুণ কণ্ঠে উদাসীন প্রেয়সীরে ডাকে। সন্ধ্যাতারা দিগন্তের কোণে শিরীষ পাতার ফাঁকে কান পেতে শোনে যেন কার পদধ্বনি দক্ষিণ-বাতাসে। ঝরাপাতা-বিছানো সে ঘাসে বাঁশরি বাজাই আমি কুসুমসুগন্ধি অবকাশে। দূরে চেয়ে থাকি একা-- মনে করি যদি কভু পাই তার দেখা যে পথিক একদিন অজানা সমুদ্র উপকূলে কুড়ায়ে পেয়েছে চাবি, বক্ষে নিয়ে তুলে শুনিতে পেয়েছে যেন অনাদি কালের কোন্ বাণী, সেই হতে ফিরিতেছে বিরাম না জানি। অবশেষে মৌমাছির পরিচিত এ নিভৃত পথপ্রান্তে এসে যাত্রা তার হবে অবসান; খুলিবে সে গুপ্ত দ্বার কেহ যার পায় নি সন্ধান।
দূরে গিয়েছিলে চলি; বসন্তের আনন্দভাণ্ডার তখনো হয় নি নিঃস্ব; আমার বরণপুষ্পহার তখনো অম্লান ছিল ললাটে তোমার। হে অধীর, কোন্ অলিখিত লিপি দক্ষিণের উদ্ভ্রান্ত সমীর এনেছিল চিত্তে তব। তুমি গেলে বাঁশি লয়ে হাতে, ফিরে দেখ নাই চেয়ে আমি বসে আপন বীণাতে বাঁধিতেছিলাম সুর গুঞ্জরিয়া বসন্তপঞ্চমে, আমার অঙ্গনতলে আলো আর ছায়ার সংগমে কম্পমান আম্রতরু করেছিল চাঞ্চল্য বিস্তার সৌরভবিহ্বল শুক্লরাতে। সেই কুঞ্জগৃহদ্বার এতকাল মুক্ত ছিল। প্রতিদিন মোর দেহলিতে আঁকিয়াছি আলিপনা। প্রতিসন্ধ্যা বরণডালিতে গন্ধতৈলে জ্বালায়েছি দীপ। আজি কতকাল পরে যাত্রা তব হল অবসান। হেথা ফিরিবার তরে হেথা হতে গিয়েছিলে। হে পথিক, ছিল এ লিখন-- আমারে আড়াল করে আমারে করিবে অন্বেষণ; সুদূরের পথ দিয়ে নিকটেরে লাভ করিবারে আহ্বান লভিয়াছিলে সখা। আমার প্রাঙ্গণদ্বারে যে পথ করিলে শুরু সে পথের এখানেই শেষ। হে বন্ধু, কোরো না লজ্জা, মোর মনে নাই ক্ষোভলেশ, নাই অভিমানতাপ। করিব না ভর্ৎসনা তোমায়; গভীর বিচ্ছেদ আজি ভরিয়াছি অসীম ক্ষমায়। আমি আজি নবতর বধূ, আজি শুভদৃষ্টি তব বিরহগুণ্ঠনতলে দেখে যেন মোরে অভিনব অপূর্ব আনন্দরূপে, আজি যেন সকল সন্ধান প্রভাতে নক্ষত্রসম শুভ্রতায় লভে অবসান। আজি বাজিবে না বাঁশি, জ্বলিবে না প্রদীপের মালা, পরিব না রক্তাম্বর; আজিকার উৎসব নিরালা সর্ব-আভরণহীন। আকাশেতে প্রতিপদ-চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ পার হয়ে পূর্ণতার প্রথম প্রসাদ লভিয়াছে। দিক্প্রান্তে তারি ওই ক্ষীণ নম্র কলা নীরবে বলুক আজি আমাদের সব কথা বলা।